আজ স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মদিনে তাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।

নভেম্বর ৩০, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্মদিন

বিজ্ঞানী স্যার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ,পারিবারিক আদি নিবাস ঢাকার ,বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রাম হলেও স্যারের জম্ম হয় নভেম্বর ৩০, ১৮৫৮ ময়মনসিংহে ।
তার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এর পূর্বে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্রই এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোন।

বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ব করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে। এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো। ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক।
বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকুল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন।

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র গবেষণাগারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই ইলেকট্রিক রেডিয়েশন বিষয়ে গবেষণা করতেন। বিদ্যুৎ উৎপাদক ইথার তরঙ্গের কম্পনের দিকে পরিবর্তন বিষয়ক প্রবন্ধটি (যা তাঁর প্রথম প্রবন্ধ) তিনি এশিয়াটিক সোসাইটিতে পেশ করেছিলেন। পরের প্রবন্ধগুলো ইংল্যান্ডের ইলেকট্রিশিয়ান পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এসময় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বিনা তারে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মাধ্যমে শব্দকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিভাবে পাঠানো যায় সে বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। একই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন আমেরিকার বিজ্ঞানী লজ, ইতালীতে মার্কনী। কিন্তু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র এ বিষয়ে ছিলেন অগ্রণী।
জগদীশের আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে এ বিষয়ে পরীক্ষা করেন। বেতার যন্ত্র তখনও আবিষ্কৃত হয় নি। কলকাতার টাউন হল। সাঁইত্রিশ বছরের যুবক জগদীশ যন্ত্রপাতি নিয়ে তৈরি হয়ে আমন্ত্রিত শ্রোতাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, সর্বসমক্ষে তা পরীক্ষা করে দেখাতে চান। এর পরেই তিনি বিনাতারে তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের বাসা থেকে এক মাইল দূরে কলেজে সঙ্কেত আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করলেন। জগদীশচন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।

wireless telegraphy সম্বন্ধে তাঁর আবিষ্কার ইংল্যান্ডে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। একটি বিখ্যাত ইলেকট্রিক কোম্পানী তাঁর পরামর্শ মত কাজ করে wireless telegraphy বিষয়ে প্রভূত উন্নতি করতে সক্ষম হয়। অর্থনৈতিক কারণে জগদীশচন্দ্রের গবেষণা ব্যাহত হয়েছিল। ১৮৯৬ সালে মার্কনী wireless telegraphy- র প্রথম পেটেন্ট নিলেন।

এ বছর জুলাই মাসে ইউরোপে রওয়ানা হলেন বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র। দশ বছর আগে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছিলেন। গবেষণার ফলাফল ইউরোপীয়দের কাছে বলবেন, এই ইচ্ছে ছিল তাঁর। কলকাতার টাউন হলে যে যন্ত্র থেকে তরঙ্গ তৈরি করেছিলেন তিনি, সেই যন্ত্রটি সাথে নিয়ে গেলেন। ব্রিটেনে, জার্মানী ও ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে বক্তৃতা করলেন। শ্রোতাদের মাঝে সেসময় ছিল জে জে থমসন, যিনি ইলেকট্রনের আবিষ্কারক। আর ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন।

অবশেষে জয়ের মালা নিয়ে দেশে ফিরলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। সেসময় তাঁকে অভিনন্দন জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, ডা. নীলরতন সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রী এবং আরও অনেকে।
লন্ডনে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র অনুভব করেছিলেন বিদেশে বিজ্ঞানীরা কত আধুনিক গবেষণাগারের সুযোগ পাচ্ছে। তাঁর অনুরোধে লর্ড কেলভিন ও অন্য বিজ্ঞানীরা ভারত সচিবের কাছে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ভারতবর্ষে এসে তিনি এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন, মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯১৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরি গড়ে উঠল।

ভারতবর্ষে এসে তিনি আবার অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত। সেই সঙ্গে গবেষণাও চালিয়ে যেতে থাকলেন। এ সময়েই তাঁর উদ্ভিদ বিষয়ক যুগান্তকারী গবেষণা আরম্ভ করেন। ১৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র। এখানে তাঁর বক্তৃতায় বিষয় ছিল জীব ও জড়ের উপর বৈদ্যুতিক সাড়ার একাত্বতা। সেখানে জীব ও জড়ের সম্পর্ক বিষয়ে ব্রিটিশ এসোসিয়েশনের ব্রাডফোর্ড সভায় বক্তৃতা দিলেন।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র ১৯০২ সালে রচনা করলেন ‘Responses in the living and non living’| ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হল তাঁর দুটি গ্রন্থের মধ্যে তিনি প্রমাণ করলেন উদ্ভিদ বা প্রাণীকে কোনভাবে উত্তেজিত করলে তা থেকে একইরকম সাড়া মেলে। তিনি ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় গেলেন। আমেরিকার বিজ্ঞানীরা তাঁর আবিষ্কার সম্বন্ধে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীগণ ধীরে ধীরে গবেষণার সত্যতাকে স্বীকার করে নিচ্ছিলেন।

দেশে ফিরেই বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র তৃতীয় পর্যায়ের গবেষণা শুরু করলেন। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দেহকলার মধ্যে তুলনামূলক গবেষণা। গবেষণার এ পর্যায়ে তিনি উদ্ভাবন করলেন তাঁর বিখ্যাত যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ। এ যন্ত্রের মাধ্যমে কোন বস্তুর অতি সূক্ষ্মতম সঞ্চালনকেও বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেখানো সম্ভবপর।

আবার ১৯১৪ সালে তিনি চতুর্থবার ইংল্যান্ড গেলেন। এ বার যাত্রার সময় তিনি সঙ্গে করে শুধু যে তাঁর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নিয়ে গেলেন সেই সঙ্গে লজ্জাবতী ও বনচাঁলড়াল গাছ। এ গাছগুলো সহজে সাড়া দিতে পারে। তিনি অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, এছাড়া রয়েল সোসাইটিতেও তাঁর উদ্ভাসিত যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করলেন, জীবদেহের মত বৃক্ষেরও প্রাণ আছে, তারাও আঘাতে উত্তেজনায় অণুরণিত হয়।

১৯১৩ সালে জগদীশচন্দ্রের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর চাকরির মেয়াদ আরো দু’বছর বাড়ানো হয়। ১৯১৫ সালে সুদীর্ঘ ৩১ বছর অধ্যাপনা করার পর চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেন। চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেও গবেষণার কাজ চলতে থাকলো। এ সময় তিনি লন্ডনের রয়েল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আলোকে ভারতবর্ষে এ ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ার পরিকল্পনা করলেন। পরিচিতজনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তাঁর ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন। এ কাজে অনেক মানুষ এগিয়ে এলেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঘুরে জগদীশচন্দ্র অর্থ সঞ্চয় করলেন। তাছাড়া তিনি নিজের সমস্ত জীবনের উপার্জিত অর্থ এ প্রতিষ্ঠানে দিলেন। সরকারে তরফ থেকে বার্ষিক অনুদান নির্ধারণ করা হলো। ১৯১৭ সালে ৩০ নভেম্বর জগদীশচন্দ্রের ৫৯তম জন্মদিনে প্রতিষ্ঠা হল বিজ্ঞানমন্দির। তাঁর এ প্রতিষ্ঠান শুধু ভারতবর্ষ নয, সমগ্র বিশ্বের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষণাগার।

বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্রের সফলতার কথা কর্মজীবন অংশেই উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া তিনি বিজ্ঞান গবেষণায়ও প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছিলেন যার জন্য তার সুখ্যাতি তখনই ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তিনি তা প্রমাণ করেন। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। আর আইনস্টাইন তার সম্পর্কে নিজেই বলেছেনঃ
“জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিৎ”।

তার অসামান্য অবদানের জন্য দেশে বিদেশে বিভিন্ন সন্মাননায় ভূষিত হনঃ
নাইটহুড, ১৯১৬
রয়েল সোসাইটির ফেলো, ১৯২০
ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য, ১৯২৮
ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি, ১৯২৭
লিগ অফ ন্যাশন্‌স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন -এর সদস্য
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিষাঠাতা ফেলো। এর বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি।
(Source: Bangla Moon)

Scroll to Top